একটা নিকৃষ্টমানের ষড়যন্ত্র করেছে এরা - এই কান্না সেটা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে ভীত হবার কারণেই।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রিয় সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসাউদ এনটিভিতে একটি টক শোতে এসে কান্নাকাটি করে বলেছে, তাদের গণঅভ্যূথান না কি ব্যর্থ করে দেয়া হচ্ছে। তার অভিযোগ যারা তাদের সামনে ঠেলে দিয়েছে তারাই নাকি এখন আওয়ামী লীগকে পূনর্বাসন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এমনকি সে কথার মাঝে একটি হুমকিও দিয়েছে যারা পেছন থেকে তাদের সামনে ঠেলে দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের মুখোশ সে উম্মোচন করে দিবে।

তার কথার অর্থ (আমি যা বুঝি), তাদের পেছনে কেউ ছিল। এই কথাটি এক সময় আমরা অনেকেই বলেছি। এর বাইরে কেউ সেটা বিশ্বাস করেনি। এমনকি সেই কথাকে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যাতে আমাদের কথাগুলো গুরুত্ব না পায়। এর পেছনে একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল 'নিরপেক্ষ' ছদ্মবেশে। তারা মুখে বলে 'আই হেইট পলিটিক্স' কিন্তু সত্য হলো তারা অন্তরে ধারণ করে 'আই হেইট মুক্তিযুদ্ধ' যা তারা প্রকাশ করে না। না, আমি গত ১৬ বছরের আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের সাথে মিলিয়ে ফেলছি না। তবে এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও জেনোসাইডের সাথে জড়িত থাকার দায়ে যাদের সাজা হয়েছে তাদের একটি বড় অংশ জামায়াতের নেতা ছিলো। জামায়াত শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি। তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে সশস্ত্রভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অংশ গ্রহণ করেছে। তাদের নেতাদের যখন ফাঁসি হয় তারা সেটার প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নেয়। তরুণ প্রজন্মের ভেতর নানাভাবে তাদের কর্মীরা ঢুকে পড়ে বিভিন্ন মুখোশের আড়ালে। বিগত সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার বাইরে যেয়ে তারা নানা ধরণের প্রোপাগান্ডা প্রচার করতে থাকে, বিভ্রান্ত করতে থাকে তাদের। এদের একটা ফ্রন্ট এতোটাই বেশ ভূষা পরিবর্তন করে মিশে গিয়েছিল যাদের কেউ ভাবতেই পারেনি এরা জামায়াতের এজেন্ট। এরা গান-কবিতা করে, এরা খুব আধুনিক পোশাক পরে, এরা সংস্কৃতিমনাদের সাথে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব করে। ৫ই আগস্টের আগ পর্যন্ত এরা মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলে কৌশলে এড়িয়ে যেতো। এখন এদেরকে মুক্তিযুদ্ধের শহিদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করলে এরা বলবে, ওসব বাড়িয়ে বলা। জাতির জনক প্রশ্নে এরা বলবে এসব আওয়ামী লীগের আরোপিত। এমনকি মুক্তিযুদ্ধকেও এরা এখন আওয়ামীলীগের একক আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে এটা বুঝাতে যে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চায়নি।

এই গেইমটা ভয়াবহ। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়েছে। তার নেতৃত্ব দিয়েছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান নেতা মেনেই। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আগের দীর্ঘ সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কাছাকাছি অবদান কারো নেই। অনেক নেতাই নানা সংগ্রামের, আন্দোলনের জন্য প্রাসঙ্গিক ছিলেন। কিন্তু সেটা বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের এক দশমাংশও নয়। এসব ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা আগেও হয়েছে, যা এখনো আবার হচ্ছে। তাই বলে সেসব তলিয়ে যাবে না, হারিয়ে যাবে না।

এবার আসি, সমন্বয়ক হান্নানের এই কান্নাকাটির প্রসঙ্গে। হান্নানরা জানতো পেছন থেকে তাদেরকে সব রকম পরিকল্পনা ও লজিস্টিকস দিয়ে সহায়তা করেছে বিভিন্ন শক্তি। এমনকি মুখ ফসকে সে বলেও ফেলেছে তা। এই কথাগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেনি, যখন আমরা বলছিলাম। হান্নানরা এখন এসে এই কান্নাকাটির পেছনে কারণ কী! কারণ, হলো তারা বুঝতে পেরেছে তারা একটি চক্রান্ত করেছে। এই চক্রান্ত থেকে তারা নিজেরাই রক্ষা পাচ্ছে না। তারা ব্যবহৃত হয়েছে। কেন্দ্রিয় সমন্বয়কদের শিবির ও হিজবুত তাহরীর আদর্শের কথা এখন মোটামুটি প্রমাণিত। বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থী ও যাদের তারা ছাত্রজনতা আখ্যা দেয়, তারা কখনোই তাদের এই পরিচয় স্বাভাবিকভাবে নিবেনা। তাই এখন তাদের ডাকে কয়েক ‘শ শিবির কর্মীর বাইরে কেউ সাড়া দেয় না। তারা টের পেয়েছে, তারা যদি এমনকি নির্বাচন করে তাতেও তারা জয়ী হয়ে আসতে পারবে না। এর জন্য তাদের প্রয়োজন বড় কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থন। যেহেতু, তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে তাই তাদের সমর্থন তারা কোনভাবেই পাবে না। অপরদিকে বিএনপির মতো বড় দলকে তারা ইতিমধ্যে নানা রকম হুমকি ধামকি দিয়ে শত্রু বানিয়ে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থানের কারণে এই সময়ে এসে বিএনপিও তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজেরা প্রশ্নবিদ্ধ হতে চাইবে না।

এর সাথে আবার জড়িত বৈশ্বিক রাজনীতি। এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আগের মতো সমর্থন দিতে পারবে না ইউনুস সাহেবকে। সেদিকে তার শক্তি হারিয়ে, মুখে যাই বলুক ট্রাম্পের সাথে ভারতকে ডিঙ্গিয়ে আলাদা করে সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগও নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি বদলায় না - এসব হলো নিজেদের সান্ত্বনা দেয়া। প্রশাসনের উপর নির্ভর করে নীতি না বদলালেও শত্রু-মিত্র বদলায়।

হান্নানের এই কান্না ভয়ের কান্না। তারা মুখে এখন যাই বলুক না কেন, শিবিরের রাজনীতি যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মন থেকে স্বাগত জানায় না - এটা বুঝতে পারার ভয় তাদের পেয়ে বসেছে। তারা ভুলে গিয়েছিল - মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশের মূল স্তম্ভগুলোকে যতই 'মুজিববাদি' ট্যাগ দেয়া হোক না কেন - এই স্তম্ভগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে এই জাতি তাদের ছুড়ে ফেলে দিবে। জামায়াতি-বামাতিদের পাঠচক্রগুলোই যে সমগ্র বাংলাদেশ নয় এটা তারা বুঝতে পারেনি।

মুজিববাদ - সেটা শাব্দিক প্রয়োগে হোক আর না হোক - বাংলাদেশের ভিত্তি এই চারটি মূলনীতির উপরেই দাঁড়িয়ে। এই চার মূলনীতিকে সামনে রেখেই এই দেশের জন্ম। এমনকি 'বাংলাদেশ' নামটিও মুজিবের দেয়া। যেই পতাকা কপালে নিয়ে তারা তথাকথিত বিপ্লব করেছে, সেটাও ছাত্রলীগের তৈরি করা। এইসব কিছুকে ছুড়ে ফেলার কথা বলবা, আর বাংলাদেশের মানুষ তোমাদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগবে - এতো বোকা ভাবাটা ঠিক না। জাতির একটা অংশকে বিভ্রান্ত করে, পুরো জাতির ইতিহাসকে অবমাননা করে তোমরা ভাল থাকতে পারবা না। আজ হতে অনেক বছর পরে ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করবে তারা তোমাদের ২৪ এর মীরজাফর হিসেবেই আখ্যায়িত করবে।

একটা নিকৃষ্টমানের ষড়যন্ত্র করেছে এরা - এই কান্না সেটা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে ভীত হবার কারণেই। মুখে যতই ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্টদের দোসরদের পূনর্বাসনের কথা বলুক না কেন। ভয়টা আদতে মনের ভেতর অন্য কোথাও।

এইসব কান্নাকাটি করে মানুষকে আরেকবার বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই।




All Comments